রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত কেন হয়?
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বর্তমানে একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে এই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঝলসে গিয়েছেন আবার অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি মনে করি, আমাদের কিছু ভুলের কারণেই এমনটা ঘটে থাকে। হয়তো অনেক সময় ব্যাতিক্রম হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই নিজের অসাবধানতার কারণেই এমনটা ঘটে থাকে।
(চিত্র সূত্র: LPG leak whiff in kitchen fire)
গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো চাপ, তাপ এবং ছিদ্র।
গ্যাস সিলিন্ডারে যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস ভর্তি করা হয় তাহলে তা বিপদ ডেকে আনে৷ আমরা যে গ্যাস সিলিন্ডার গুলো ব্যাবহার করে থাকি তা প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ২৫ কেজি চাপ নিতে পারে। অর্থাৎ, গ্যাস সিলিন্ডারে আমাদের আঙ্গুলের ডগার সম পরিমাণ জায়গায় ২৫ কেজি চাপ পরে৷ কিন্তু, এত পরিমাণ চাপ সিলিন্ডারের ভেতর থাকেনা। আমাদের সিলিন্ডার গুলোতে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৫ কেজি করে চাপ প্রয়োগ হয়। যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। কেউ যদি অসাবধানতাবশত বেশি গ্যাস ভর্তি করে ফেলে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
(চিত্র সূত্র: Maximum Explosion Pressure)
তাপের কারণেও বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। অনেকে বাসাবাড়িতে চুলার কাছেই সিলিন্ডার স্থাপন করে থাকেন৷ ফলে, তাপ সরাসরি সিলিণন্ডারের গায়ে লাগে। এই তাপ প্রবাহিত হয় সিলিন্ডারের ভিতরে। এতে করে ভিতরে থাকা গ্যাস উত্তপ্ত হয়ে যায়। গ্যাস উত্তপ্ত হলে কি হয় সেটা হয়তো অনেকের মাথায় আসেনা। দেখে নিই!
একটু করে গণিতের সাহায্য নিই।
আদর্শ গ্যাসের সূত্র থেকে আমরা জানি,
PV=nRTPV=nRT
এখানে,
PP= চাপ (প্যসকেল [Pa])।
VV= আয়তন (ঘনমিটার [m3m3])।
nn= মোল সংখ্যা।
R=R= আদর্শ গ্যাস ধ্রুবক।
T=T= তাপমাত্রা।
সূত্রটি থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, তাপমাত্রা, চাপের সমানুপাতিক। মানে তাপ যত বাড়বে চাপ ও তত বাড়তে থাকবে। আগেই জেনেছি, গ্যাস সিলিন্ডার গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় কম চাপ থাকে। কিন্তু, যখন তাপ প্রয়োগ করা হয় বা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন, সিলিন্ডারের গায়ে প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে চাপ ও বাড়তে থাকে। যতই তাপমাত্রা বাড়বে গ্যসের অনুগুলোর ছুটোছুটি বেড়ে যাবে। অর্থাৎ, গ্যাসের প্রতিটি অণুর গতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে। তারা গ্যাস সিলিন্ডারের গায়ে জোরে জোরে আঘাত করবে। এই আঘাত করার ফলে প্রতিবর্গসেন্টিমিটারে চাপের পরিমাণ বেড়ে যাবে। সধারণত, সিলিন্ডারে গ্যাস তরল অবস্থায় থাকে। তাপ প্রয়োগের ফলে তরল গ্যাস বাষ্পে পরিণত হতে শুরু করে। বাষ্প মানেই গ্যাসের অণুর ছোটাছুটি। এরফলে সিলিন্ডারে ফাটল ধরে এবং গ্যাস বাইরে বেরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে BLEVE (Boiling Liquid Expanding Vapour Explosion)।
এক্ষেত্রেও একটা সহজ সূত্রের সাহায্য নেয়া যায়,
P1T1=P2T2P1T1=P2T2
এখানে,
P1P1= প্রাথমিক চাপ (চুলা জ্বালানোর পূর্বে)।
T1T1= স্বাভাবিক তাপমাত্রা (কক্ষতাপমাত্রা/ চুলা জ্বালানোর পূর্বে)।
P2P2= সর্বশেষ চাপ ( চুলা জ্বালানোর পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রায়)।
T2T2= সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এখানে, আমরা তিনটা জিনিস সহজেই জানতে পারি, P1P1, T1T1 এবং T2T2 এর মান। তাহলে আমরা ঐ মানগুলো সূত্রে বসিয়ে P2P2 এর মান বের করে ফেলতে পারি। এই মাণ বের করে আমাদের লাভ কী? লাভ বলতে, একটি সিলিন্ডার কি পরিমাণ চাপ সহ্য করতে পারে তার একটা নির্দেশিকা থাকে। আমরা রান্না করলে তাপ যদি সরাসরি সিলিন্ডারের গায়ে লাগে তাহলে কি পরিমাণ চাপ উৎপন্ন হবে তা বের করে নিতে পারি। এই চাপ যদি সিলিন্ডারের নির্দেশিত চাপের চেয়ে বেশি হয় তাহলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এই অঙ্ক কষাকষির ঝামেলায় যদি পরতে না চেয়ে থাকেন, সিলিন্ডারকে অবশ্যই অনুকুল তাপমাত্রায় রাখুন। অর্থাৎ, চুলা থেকে দূরে রাখুন যেখানে তাপ না পৌঁছায়।
সবশেষ কারণটি হলো, ছিদ্র বা Leakage. এই কারণেই বিস্ফোরণের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। অনেকে গ্যাস সিলিন্ডারের নব(রেগুলেটর) টা বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে থাকেন। যার ফলে গ্যাস বের হয়ে আসে। যদি ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকে তো গ্যাস বাইরে বেরুতে পারেনা। তখন গ্যাস জমে থাকে। এই জমে থাকা গ্যাস যখন আগুনের সংস্পর্শে আসে তখনই বিস্ফোরণের সূত্র পাত ঘটে৷ অনেকসময়, সিলিন্ডার পুরাতন হয়ে জং ধরে ছিদ্রের সৃষ্টি করে। এই ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়ে আসে আর আগুনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটায় আর আমরা আগুনে পুড়ে মরি।
(চিত্র সূত্র: Maximum Explosion)
আবারো বলছি, একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে এত সূত্রের সাহায্য নিতে হবেনা। গ্যাস সিলিন্ডার আনার সময় দেখে-শুনে আনুন আর ব্যাবহার সাবধানে করুন। ভয়ের কারণ নেই সেটা বলবোনা, এগুলো একেকটা ছোটোখাটো বোমার মত মনে হয় আমার কাছে। মানে আমরা বাসায় বোমা নিয়েই থাকি। এটা মনে মনে রাখুন আর সাবধানে থাকুন।