কোরআনের আয়াতের বিরুদ্ধে কোনো সিহাহ সিত্তার হাদিস গেলে, সেটার বিষয়ে করণীয় কী?
কোরআনের আয়াতের বিরুদ্ধে কোনো সিহাহ সিত্তার হাদিস গেলে, সেটার বিষয়ে করণীয় কী?
কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস।
এগুলোর মাঝে কুরআন ও হাদীস হলো স্বতন্ত্রভাবে মৌলিক দুটি উৎস, আর ইজমা ও কিয়াস হচ্ছে কুরআন ও হাদীস কতৃক সমর্থিত দুটি যৌগিক উৎস।
এবার প্রশ্ন যেহেতু হাদীস নিয়ে তাই হাদীস নিয়েই আলোচনা করছি।
প্রথমেই এটা জেনে রাখা অত্যাবশ্যক যে সিহাহ সিত্তাহ বা হাদীসের প্রধান ছয়টি গ্রন্থ মানেই এমন নয় যে এগুলোতে যতগুলো হাদীস আছে সবগুলোই সহীহ বা গ্রহণযোগ্য, অথবা এই সিহাহ সিত্তার যেসকল হাদীসগুলো সহীহ, সেগুলো অন্যান্য হাদীস-গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীসগুলোর চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
বরং প্রচুর যঈফ অথবা দুর্বল এমনকি জাল হাদীসও সিহাহ সিত্তার হাদীসগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। আর এটাও বেশ বড়রকমের ফাউ একটা কথা যে অন্যান্য গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীসগুলোর চেয়ে সিহাহ সিত্তার হাদীসগুলো বেশি শক্তিশালী। বরং উভয় গ্রুপই হাদীসের শুদ্ধতার মাত্রা কমবেশি হওয়ার মামলায় গুরুত্বের দিক থেকে একই শ্রেণীর, শুধু বিশেষ কিছু বিচ্ছিন্ন কারণে উভয়ের ক্ষেত্রগুলো জাস্ট আলাদা। আর সিহাহ সিত্তার শুধু গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে প্রাধান্য অর্জিত হয়ে গেছে, এই হচ্ছে কথা।
তাই সিহাহ সিত্তার কোনো হাদীসই কুরআনের বিপক্ষে যেতেই পারে না- এমনটা কেউ ভেবে বসলে তা হবে বেশ বোকা বোকা ও মূর্খতাপূর্ণ এক ব্যাপার। কারণ সিহাহ সিত্তার মধ্যে যেই দুর্বল এবং বানোয়াট হাদীসগুলো রয়েছে সেগুলোর কোনো কোনোটা কিন্তু কুরআনের বিরুদ্ধে যেতেই পারে, স্বাভাবিক ব্যাপার। আর দুর্বল কিংবা বানোয়াট হাদীস তো এমনিতেই কুরআনের বিপক্ষে না গেলেও সাধারণ পর্যায়ে আমলযোগ্য নয়। (তবে একাধিক শর্তসাপেক্ষে যে দুর্বল হাদীস কুরআনের বিপক্ষে যায়নি তার ওপর আমল করা যাবে, অবশ্য বানোয়াট হাদীস এর ব্যতিক্রম কেননা এটা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য।)
তাই এই জাল-যঈফগুলোর কারণেই কিন্তু পুরো সিহাহ সিত্তা আগাগোড়া সহীহ হতে পারেনি।
বাকী রইলো সিহাহ সিত্তার সহীহ হাদীসগুলোর কথা।
তা কথা হচ্ছে যে, সহীহ হাদীসগুলোও কি কুরআনের বিপক্ষে যেতে পারে?
মূলত এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়াটা একদমই বৈধ নয়। বরং শুধুই সিহাহ সিত্তাহ নয়, বরং এগুলো ছাড়া আরও যতগুলো হাদীসের গ্রন্থ রয়েছে সেই সবগুলো গ্রন্থের গ্রহণযোগ্য সহীহ হাদীসগুলো প্রধানত মোট তিন প্রকারের।
মুতাওয়াতির, মাশহুর ও খবরে ওয়াহেদ।
মুতাওয়াতির এবং মাশহুর, এই দুই শ্রেণীর হাদীসের সাথে কুরআনের বিরোধিতা থাকা নীতিগতভাবে অসম্ভব। আর বাস্তবেও আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত এই দুই গ্রুপের মাঝে কোনো বিরোধিতা পাওয়া যায়নি।
তাই “কুরআন নাকি এই দুইটার কোনো একটাকে বাদ দিতে হবে” এমন কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
তবে খবর ওয়াহেদ যেটা বললাম, সেটা সহীহ হলেও সামান্য কিছু অসম্পূর্ণতার কারণে তা মুতাওয়াতির এবং মাশহুরের সমান হতে পারেনি। আবার কখনো কখনো একে কুরআনের সাথে বিরোধিতা করতেও দেখা গেছে। তো বলাই বাহুল্য যে কুরআনের বিপক্ষে সেই খবরে ওয়াহেদ হাদীসকে মোটেও সবসময়ের জন্য শক্তপোক্ত সমর্থনকারী হিসেবে দাঁড় করানো সম্ভব হবে না।
তবে হ্যাঁ, কোনো খবরে ওয়াহেদ আপাতদৃষ্টিতে কুরআনের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে হলেই যে সেটাকে দেয়ালে ছুড়ে ফেলতে হবে ব্যাপারটা কিন্তু একদমই তেমন নয়, বরং এটা হাদীসের বিরুদ্ধে অবহেলা কিংবা অবজ্ঞাবশত তৈরী হওয়া চরমপন্থার একটি কুৎসিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এক্ষেত্রে বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে যেন যথেষ্ট জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ পরহেজগার আলেমগণ কতৃক কুরআন এবং এই খবরের ওয়াহেদের মাঝে সমন্বয় সাধন করা যায়, যেটাকে উসুলে ফিকহের পরিভাষায় “তাতবীক” বলে।
তো চেষ্টার পরও যদি তাতবীক সম্ভব না হয় তাহলে তখনই হাদীসটিকে বাদ দেওয়া যাবে, আর যদি তাতবীক করেই ফেলা যায় তাহলে তো আর কথাই নেই, হ্যাপি অ্যাডজাস্টমেন্ট !
তবে অনেকে আবার তাতবীকের ক্ষেত্রে জালিয়াতিও করে থাকে, যেমন কুরআন থেকে অলরেডি নিজেদের প্রবৃত্তির পক্ষে মনমতো কোনো একটা আয়াত বেছে নেয়, পরে সেটার সমর্থনে অন্য আরেকটা এমন খবরে ওয়াহেদকেও ব্যাখ্যা হিসেবে দাঁড় করায় যেটা আদতে তাদের প্রবৃত্তির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক ছিল, পক্ষে নয়।
তো এভাবেই ওরা সুক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করে সেটাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে নিজেদের প্রবৃত্তির চাহিদাকে আরও বেশি বৈধ করার কুপ্রচেষ্টা চালায়। তো এ ধরনের প্রবৃত্তিপূজারী কথিত ইসলামী গবেষক ও আলেমদের খুঁজে বের করে তাদের থেকে আমাদেরও যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার সুপ্রচেষ্টা চালাতে হবে।
উসুলে ফিকহের গ্রন্থগুলোতে খবরে ওয়াহেদ বাদ দেওয়ার কিংবা তাতবীক করার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। যে খবরে ওয়াহেদই কুরআনের সাথে টক্কর দিয়েছে তা হয় বাদ পড়ে গেছে আর নয়তো কোনোভাবে নিজেকে অন্য কোনো উপায়ে সামলে নিয়েছে।
যেমন কুরআন থেকেই বোঝা যায় যে প্রাপ্তবয়স্কা নারী নিজ থেকেই বিয়ে করতে পারবে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই (২:২৩০ ও ২৩২), অথচ সহীহ একটি খবরে ওয়াহেদে নারীর বিয়ের শুদ্ধতার জন্য অভিভাবকের উপস্থিতিকে শর্ত করা হয়েছে যেন অনুমতি লাভ করা যায়, পুরোই উল্টো ব্যাপার কিন্তু।
অতএব হাদীসটি কুরআনবিরোধী, আর এদের মাঝে তাতবীক করাও বেশ মুশকিল বা অসম্ভব বিধায় অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম একে বাদ দিয়েছেন। এটা হচ্ছে খবরে ওয়াহেদ বাদ দেওয়ার উদাহরণ।
আবার কুরআনে ওজুর ক্ষেত্রে নিয়ত করার কোনো শর্ত করা হয়নি, কিন্তু সহীহ হাদীসে যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে নিয়ত করার কথা এসেছে যার মাঝে ওজুও আসে।
তো এখন যেহেতু উভয়ের মাঝে বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে অথচ উভয়টাই জরুরী তাই উভয় মতকে টিকিয়ে রাখতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যে কুরআনে যা যা করার কথা বলা হয়েছে ততটুকু হবে ফরজ আর হাদীসে যতটুকু এসেছে ততটুকু হবে সুন্নাহ। এটা ছিলো তাতবীক।
এছাড়াও মজার কথা হচ্ছে যে খবর ওয়াহেদ সহীহ হয়েও এতটাই দুর্বল হতে পারে যে এটা যদি কোনোভাবে কিয়াসের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে কিয়াসও এর ওপর প্রাধান্য পাবে। অথচ কিয়াস হচ্ছে যৌগিক, মৌলিক নয় যেমনটা আমরা জেনে এসেছি। তো কিয়াসের ব্যাপারে যখন এই কথা, তাহলে মুতাওয়াতির এবং মাশহুরের সাথে কনফ্লিক্ট দেখা দিলে তো আরো আগে বাদ পড়ে যাবে।
খবরে ওয়াহেদের কিয়াস ও অন্যান্য হাদীসগুলোর সাথে টক্কর দেওয়ারও অনেক উদাহরণ রয়েছে, তবে আলোচনা আর দীর্ঘ করতে চাচ্ছি না বলে সেগুলো আনলাম না। আর যতটুকু আলোচনা করলাম তা অনেকটাই ক্ষুদ্র, নয়তো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হলে কয়েক পর্বে চালিয়ে যেতে হবে, উসূলে ফিকহে এবিষয়ক অধ্যায়ের ফিরিস্তি বেশ দীর্ঘ।
শেষমেষ জরুরী যে কথাটা না বললেই নয় তা হচ্ছে, ঢালাওভাবে এককথায় একথা বলা একদমই সঠিক নয় যে কোনো একটা হাদীস কুরআনের বিপক্ষে গেলেই তা ফেলে দিতে হবে; যেমনটা এই প্রশ্নের অন্যান্য উত্তরগুলোতে অসভ্য ও অশিক্ষিত কিছু উত্তরদাতা উল্লেখ করেছে।
আবার সেই সকল লোকদের ধারণাও ভুল যারা মনে করে যে একটা সহীহ হাদীস মানেই তা অনেক বিশাল কিছু, অথবা হাদীস সহীহ হওয়ার অর্থই হচ্ছে সেটাকে চরমভাবে মানতে হবে; না মেনে উপায় নেই, কিংবা কাউকে কোনো একটা সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে বলতে শুনলেই তাকে কাফের, ভন্ড, বিদআতি হেনতেন আরো কত কিছু বলা- মোটকথা এসবই মূর্খতাসূলভ কাজ যেমনটা উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে বোঝা গেল, ক্লিয়ার?
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যেকোনো বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভের তৌফিক দিন, আর তা যেন সততার অধিকারী জ্ঞানীদের থেকেই অর্জিত হয়, অসভ্যদের থেকে নয়। আমীন ইয়া রব…