তিন, চার বা অতিরিক্ত ক্যামেরার ফোনগুলোয় এতো ক্যামেরা থাকার কারণ কী?
তিন, চার বা অতিরিক্ত ক্যামেরার ফোন
আজ সবার হাতে হাতেই পছন্দের স্মার্টফোন। কেউ গান শুনছেন, কেউবা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন, আবার কেউবা দিন-রাত এক করে শুধু ছবিই তুলছেন। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ করেই মনের জানালায় প্রশ্ন আসে- প্রিয় স্মার্টফোনটির ক্ষুদ্র এই ক্যামেরাটি কিভাবে এত সুন্দর ছবি তুলছে! ক্যামেরা তো একটাও থাকতে পারত। এতগুলা কেন?
একাধিক ক্যামেরা বনাম সিঙ্গেল ক্যামেরার প্রসঙ্গ আসলে প্রথমেই মাথায় আসে গুগলের পিক্সেল সিরিজ, যেটা এখনো সিঙ্গেল ক্যামেরার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এদিকে এলজির ভি সিরিজ শুরু করেছিল ট্রিপল ক্যামেরার প্রচলন। আবার হুয়াওয়ে মেট২০প্রো ট্রিপল সেটাপ দিয়ে অর্জন করে নিয়েছে সেরা ক্যামেরার তকমা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কোনটা আল্টিমেটলি ভালো? সিঙ্গেল ক্যামেরা নাকি একাধিক ক্যামেরা? যদি ট্রিপল ক্যামেরাই এত ভালো হয়, তাহলে পিক্সেল একটা ক্যামেরা কেন্দ্রিক ফোন হওয়া সত্ত্বেও কেন ট্রিপল ক্যামেরা দিয়ে ফোনকে অলংকৃত করছে না?
চলুন দেখা যাক এতগুলো ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা—
প্রাইমারি ক্যামেরা:
এই ক্যামেরার কাজ মূলত সুপার ডিটেইলড, একুরেট কালার (অনেকসময় দৃষ্টিনন্দন কালার), খুবই স্ট্যাবল শট এবং হাই রেজুলেশন ভিডিও ধারণ করা। পিক্সেল ফোনগুলির রিয়ার ক্যামেরাতে শুধু এই প্রাইমারি স্ট্যান্ডার্ড ক্যামেরাই ইউজ করা হয়। সকল ফোনে যতই ক্যামেরা সেন্সর থাকুক, এটাই সকল ফোনের স্ট্যান্ডার্ড সেন্সর। এই সেন্সর লো লাইটেও ভালো পারফর্ম করার জন্য তৈরি যার ফলে চওড়া এপার্চার এবং বড় সেন্সর সাইজ দেওয়া হয়। অনেক সময় পিক্সেল বাইন্ডিং টেকনোলজিও দেওয়া থাকে এই ক্যামেরায় যাতে কালার একুরেসি এবং লো লাইট পারফরমেন্স আরো উন্নত হয়।
টেলিফটো ক্যামেরা:
নাম শুনেই সবাই বুঝে ফেলেছেন এর কাজ কি। এই ক্যামেরা মূলত দূরের জিনিসকে কাছে টেনে আনে। কিন্তু এটা তো সিঙ্গেল ক্যামেরার সিম্ফনি মোবাইলেও করা যায়, তাই না? আসলে সেইসব জুম বলেন আর গুগলের সফটওয়্যার বেজড টেলিফটোই বলেন, এগুলি হলো স্ট্যান্ডার্ড ফটোর ক্রপ করা ভার্শন।
তবে অপটিক্যাল জুমে আপনি সম্পূর্ণ রেজুলেশন ফটোটাই পাবেন। টেলিফটো লেন্সে ফোকাল লেংথ বেশি থাকে ফলে তারা খুব ছোট অংশই ক্যাপচার করে সাধারণ লেন্সের তুলনায় এবং এই কম অংশটাই ফুল রেজুলেশন জুড়ে থাকে। যার ফলে ক্লিয়ার একটা ইমেজ পাওয়া যায় যেটা ক্রপড ইমেজে পাবেন না।
টেলিফটো যে শুধু দূরের জিনিস কাছেই তুলতে সাহায্য করে তা কিন্তু নয়। ফোকাল লেংথ বেশি হওয়ায় ব্যাকগ্রাউন্ডে বেশি ডেপথ তৈরি হয়। টেলিফটো লেন্স দিয়ে পোট্রেইট ছবি তুললে আসল ডেপথ অফ ফিল্ড পাওয়া যায় যা কৃত্রিম ডেপথ এর চেয়ে অনেক ভালো কোয়ালিটি সম্পন্ন।
অনেকেই হয়তো বলবেন পিক্সেল তো সেরা পোট্রেট তুলতে পারে, হ্যাঁ পারে। কারণ, কোনো ফোনই শুধু টেলিফটো দিয়ে পোট্রেইট তোলে না, সব ফোনেই কৃত্রিম পোট্রেইট তোলা যায়। আর গুগলের আউটপুট ভালো আসে এর অসাধারণ সফটওয়্যার দক্ষতার কারণে।
গুগলের চেয়ে ভালো পোট্রেইট চান?
তাহলে শুধু টেলিফটো ক্যামেরা অন করে দূর থেকে একটা মানুষের হাফ ছবি তুলুন, শুধুই টেলিফটো মোডে, পোট্রেইট মোডে নয়। এবার একই হাফ ছবি নরমাল লেন্স দিয়ে কাছে থেকে তুলুন। দেখুন টেলিফটো ইমেজটাতে হালকা একটা ডেপথ অফ ফিল্ড এসেছে, এটা একদম খাঁটি ডেপথ অফ ফিল্ড। ভাবছেন এইটুকু ডেপথ অফ ফিল্ড দিয়ে কাজ কি? কাজ আছে। যখন কোনো ফুলের ছবি তুলবেন বা কাছের কোনো ছোট জিনিসের ছবি তুলবেন, তখন টেলিফটো দিয়ে তুললে দেখবেন ডিএসএলআর এর মত ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার এসেছে। এটা একদম খাঁটি অপটিক্যাল ব্লার যেটা তৈরি হয়েছে বেশি ফোকাল লেংথের কারণে এবং কখনোই পোট্রেইট মোডের কোয়ালিটি এটার কাছে আসতে পারবে না।
গুগলের সফটওয়্যার বেজড টেলিফটোতে হয়ত ডিটেলসও মোটামুটি পাবেন, কারণ গুগলের সফটওয়্যার, তারা কয়েকটা ফটো একসাথে তুলে প্রতিটা পিক্সেল থেকে ডিটেইলস কালেক্ট করে এবং একটা শার্প আউটপুট দেয়, কিন্তু ফোকাল লেংথের কারুকাজ পিক্সেলের সিঙ্গেল ক্যামেরা দিয়ে সম্ভব নয়, কারণ ওটা নরমাল লেংথের ক্রপ করা ছবি ছাড়া কিছুই নয়।
ওয়াইড এঙ্গেল:
এটা বুঝতেও সাহায্য করবে ফোকাল লেংথ। অনেক কম ফোকাল লেংথের কারণে এটি সামনের বিশাল এরিয়া একসাথে দেখতে পারে। এতে করে চারপাশে একটু বেন্ডিং দেখতে পাবেন। কারণ, ক্যামেরা থেকে চারকোনার বস্তুগুলির দূরত্ব মাঝখানের বস্তুগুলির চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। এটা কিন্তু একটা অসাধারণ লুক দেয় ফটোকে যা গো প্রো এর মত একশন ক্যামেরায় দেখা যায়। ফ্যানটমের মত দামি ক্যামেরাগুলিও ইমেজকে ওয়াইড রাখার চেষ্টা করে। ওয়াইড ইমেজ অনেক দৃষ্টিনন্দন হয় যদি না সাবজেক্ট হয় একটা মানুষ।
কারো ছবি যদি ওয়াইড এঙ্গেল দিয়ে তোলেন, তাহলে তার আঁকাবাঁকা মুখ নিশ্চই ভালো দেখাবে না। কিন্তু কাছ থেকে সম্পূর্ণ খাবার টেবিল, মুক্ত আকাশ বা প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ সবগুলিই অসাধারণভাবে ভালো লাগে ওয়াইড এঙ্গেল লেন্সে। কোনো অনুষ্ঠানে গ্রুপ ফটো তুলতেও এটা কতটা দরকারি তা আন্দাজ করুন। গুগল এটাকে কিভাবে প্রেজেন্ট করবে? উপায় আছে।
প্যানারোমা মোডের কথা মনে নেই আপনাদের? গুগলও এটাই করবে স্মার্ট উপায়ে। প্যানারোমার মত কয়েকটা ফ্রেম নিয়ে একসাথে জুড়ে দিবে গুগল, হয়ে গেল গরীবের ওয়াইড এঙ্গেল। কিন্তু সিঙ্গেল শট ওয়াইড এঙ্গেল যতটা সহজ এবং সর্বদা একুরেট, প্যানারোমার ওয়াইড এঙ্গেল কি এতটা সহজ এবং প্রতিবার একুরেট হয়? উত্তরটা আপনাদের জানা আছে। স্যাম্পল ফটোর 10mm ছবিটা দেখলে ওয়াইড এঙ্গেল সম্পর্কে ধারনা পাবেন। ছবিটা এতই কাছে থেকে তোলা যে মেয়েটি নিশ্বাস নিলেও বাতাস লাগে ক্যামেরায়।
উপসংহারঃ
প্রতিটা লেন্সের আলোচনার শেষেই বলেছি গুগল কিভাবে লেন্সগুলোকে রেপ্লিকেট করছে একটা ক্যামেরা দিয়েই। কিন্তু সেগুলি যে পারফেক্ট এবং প্রাকৃতিক নয় তা গুগল নিজেও জানে। গ্রুপ ফটোতে ওয়াইড এঙ্গেলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই হয়ত ফ্রন্ট ক্যামেরায় ওয়াইড এঙ্গেল দিয়েছে গুগল। ওয়াইড এঙ্গেলের বাকি দরকারগুলিও বুঝতে বেশি সময় লাগার কথা না গুগলের। টেলিফটো লেন্সের ফোকাল লেংথটা প্রো মোবাইল ফটোগ্রাফারদের আসলেই প্রয়োজন। শুধু পোট্রেইট ছবিতেই ব্লার প্রয়োজন এরকম না, ন্যাচারাল ছবিতে ন্যাচারাল ব্লার হলে ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হয়।
এলজি তিনটা ক্যামেরাতেই অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন বসিয়ে মোবাইল ফটোগ্রাফিকে আলাদা লেভেলে নিয়ে গেছে, হুয়াওয়েও সেরা ক্যামেরা ফোন বানিয়েছে। তাই সকল কোম্পানি তিনটা ক্যামেরা দেওয়া শুরু করলে গ্রাহকদেরই লাভ। আর স্যামসাং যেখানে নচ নিয়ে ট্রল করেও ইনফিনিটি ভি দিতে পেরেছে, গুগল সেখানে সিঙ্গেল ক্যামেরা দিয়ে রাজত্ব করার পর ট্রিপল ক্যামেরা আনতে কতক্ষণ?
ও হ্যাঁ, স্যামসাং এর ৪ ক্যামেরার কথা তো ভুলেই গেছি। প্রাইমারি, টেলিফটো, আল্ট্রা ওয়াইড ও ডেপথ ক্যামেরা দিয়ে সত্যিই তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা বিশ্বকে। এবার অন্যরা কোন পথে এগোয়, সেটাই দেখার অপেক্ষায়।