মানুষ কীভাবে সময় অনুভব করে?
মানুষের স্নায়ুতন্ত্র আছে, এদের কোনোটা আমাদের স্বাদ চিনতে সাহায্য করে, কোনোটা দুর্গন্ধ বা সুগন্ধের ফারাক তৈরি করে। কিন্তু গন্ধ বোঝার জন্য যেমন স্নায়ুতন্ত্র আছে, সময় বোঝার জন্য এমন কোনো বিশেষ স্নায়ুতন্ত্র নেই। তার পরও মস্তিষ্কের কিছু জটিল ক্রিয়া আমাদের সময় বুঝতে সাহায্য করে।
মানবদেহে সার্কাডিয়ান রিদম বা সার্কাডিয়ান ছন্দ বলে একটা ব্যাপার থাকে।
এ ব্যাপারটি আমাদের সময় সম্পর্কে সচেতন করে দেয়। যেমন একজন ব্যক্তি রোজ ১০টা বাজলে ঘুমাতে যান। ঠিক ১০টা বাজলেই তাঁর চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। তিনি যদি সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন, সেটার জন্য ঘড়ির অ্যালার্ম বাজানোর দরকার হয় না।
ঠিক সময়েই তাঁর শরীর জেগে ওঠে। একান্ত অসুস্থ বা নিয়ম-কানুন না মানা মানুষের জন্য দেহিঘড়ি তেমন কাজ করে না। দেখা যায়, এ কারণে মানসিক অসুস্থতাসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
আগেই বলেছি, মস্তিষ্কের কিছু জটিল ক্রিয়া আমাদের সময় বুঝতে সাহায্য করে।
এদেরকে বলে ‘টাইম সেল’ বা সময় কোষ। এই কোষগুলো থাকে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলে। এ অঞ্চলেই মানুষের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে।
২০১৮ সালে ইঁদুরের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলে বিজ্ঞানীরা প্রথম টাইম সেলের সন্ধান পান। ২০২২ যুক্তরাষ্ট্রের দি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষক ব্রাডলি লেগা আর তাঁর সহকর্মীরা মানুষের হিপ্পোক্যাম্পাসেও টাইম সেল আবিষ্কার করেন।
লেগা অবশ্য সময় কোষ কিভাবে কাজ করে, তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, টাইম সেল কোষ কিভাবে কাজ করে, সেটা বুঝতে হলে প্লেস সেল বা ‘স্থান নির্দেশক কোষ’ কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হবে। যখন একটা প্রাণী কোনো লম্বা সরু সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে সোজাসুজি হেঁটে যায়, তখন স্থান নির্দেশক কোষগুলো রৈখিক পদ্ধতিতে সিগন্যাল দেয়। সময় কোষের ব্যাপারটাও এমন, তবে এটা সময়ের জন্য সিগন্যাল দেয়।
ধরা যাক, আপনি টিভিতে নাটক দেখবেন। নাটকটার দৈর্ঘ্য এক ঘণ্টা। কিংবা ধরুন আপনি সিনেমা দেখতে গেছেন। সিনেমার দৈর্ঘ্য দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট। কিন্তু আপনি নির্দিষ্ট করে জানেন না, ঠিক কতটুক দৈর্ঘ্য নাটক বা সিনেমার। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মস্তিষ্ক মোটমুটি একটা ধারণা করে নেয়। টিভি নাটকের জন্য ধরে নিয়েছে ৪৫-৫০ মিনিট, আর সিনেমার জন্য ধরে নিল দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা। মস্তিষ্ক এই যে সময়টা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করে নিয়েছে, এ ধরনের একেকটা সময়কালকে বলে ‘এপিসোড’ বা পর্ব। আপনার কী করছেন তার ওপর ভিত্তি করে একেকটা পর্ব কতটা দীর্ঘ হতে পারে, এটা মস্তিষ্ক অনুমান করে। লেগা বলেন, ‘আপনি কোন কোন ইভেন্টে অংশ নিচ্ছেন, তার প্রতিটার জন্য মস্তিষ্কে সময়ের আলাদা আলাদা খসড়া টেমপ্লেট রয়েছে।’
আপনার অভিজ্ঞতা যত স্পষ্ট, সময়ের পর্বগুলো তত বেশি ভাগে বিভক্ত। ধরা যাক, আপনি নিত্যদিন যেসব কাজ করেন, সেই কাজই আজ করছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতায় আসলে খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না। আর দশটা সাধারণ দিনের মতো সেই দিনটা কেটে যাবে, মস্তিষ্ক মনে রাখার মতো কিছু খুঁজে পাবে না। কিন্তু ধরা যাক, একদিন রুটিন ভেঙে কোথাও বেড়াতে গেলেন। বেশি দূরে হয়তো নয়। আশপাশের মনোরম কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে গেলেন। এক জায়গায় নয়, এক দিনে বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখলেন, প্রতিটি জায়গায় আপনার মস্তিষ্কের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলল। সেই দিনটা কিন্তু আপনার নিত্যদিনের মতো মনে হবে না। রাতে ঘুমানোর সময় সারা দিনের স্মৃতিচারণা করলে দিনটি আপনার কাছে বেশ দীর্ঘ মনে হবে। প্রতিটি জায়গার জন্য ঘোরার সময়টাকে মস্তিষ্ক আলাদা আলাদা পর্বে ভাগ করে ফেলবে। এমনও হতে পারে প্রতি পাঁচ মিনিট বা ১০ মিনিটে একটা করে পর্ব তৈরি করে ফেলেছে মস্তিষ্ক।
শুধু তা-ই নয়, যে স্থানেই গেছেন সেখানেই আলাদা আলাদা অনেকগুলো ঘটনা হয়তো ঘটে গেছে। হয়তো কোথায় ভালো ফুচকা খেয়েছেন, কোথাও নাগরদোলায় চড়েছেন, কোথাও হয়তো কারো সঙ্গে কথা-কাটাকাটাকাটি হয়েছে—এসব ঘটনাকেও আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করে ফেলবে টাইম সেল। সে ধরনের ঘটনা আবার যদি ঘটে, তখনো সেগুলোর জন্য আলাদা আলাদাভাবে সময় অনুমান করে নেবে মস্তিষ্ক। তখন প্রতিটি ঘটনার সমন্বয়ে তৈরি একটা পর্ব অনেকটাই ধীর মনে হবে আপনার কাছে। অর্থাৎ টাইম সেল ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটা ঘটনা দ্রুত ঘটছে বলে মনে আপনার কাছে। আসলে এসব পর্বগুলো, ঘটনাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ করতে পারে বালে, সেটা যদি দুই সেকেন্ডে হয় তাহলে টাইম সেল দুই সেকেন্ড পর সিগন্যাল দেবে। সেটা যদি দুই মিনিট হয়, তাহলে প্রতি দুই মিনিট পর টাইম সেল সিগন্যাল তৈরি করবে। তখন আপনি আরো সূক্ষ্মভাবে সময়ের বয়ে চলার ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।
সময় বয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে সাহায্য করে আরেক ধরনের কোষ। এদের নাম র্যাম্পিং সেল। যখন একটা নতুন পর্ব শুরু হয়, তখন র্যাম্পিং সেলগুলো তীব্রভাবে উদীপ্ত হয়। টাইম সেলের সঙ্গে র্যাম্পিং সেল কাজের সমন্বয় করেই আমাদের সময় বুঝতে সাহায্য করে।
এখন কথা হলো, স্থান আর কালকে কিভাবে মস্তিষ্ক একই সঙ্গে অনুধাবন করে। আগেই বলে বলা হয়েছে, কোনো বস্তুর অবস্থান কোথায়, সেটা বুঝতে সাহায্য করে মস্তিষ্কের প্লেস সেল। আর সময় বুঝতে সাহায্য করে টাইম সেল। একটা ঘটনা কখন কোথায় ঘটছে এ দুটি বিষয় একসঙ্গে বোঝার জন্য টাইম সেল আর ‘প্লেস সেল’ একসঙ্গে কাজ করে। একই সঙ্গে সাউন্ড বা শব্দ, গন্ধ নির্ণয়কারী কোষগুলোও একই সঙ্গে প্যাকেজ আকারে কাজ করে। এদের মিলিত কর্মকাণ্ডই আমাদের পুরো ঘটনার সময়, স্থান, গন্ধ ও শব্দ সম্পর্কে একটা স্মৃতি তৈরি করে, যেগুলো একটা পর্ব হিসে ঠাঁই করে নেয় স্মৃতি কোষে।
এভাবেই মস্তিষ্কে সময় বয়ে যাওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়।