রেললাইনের নিচে পাথর দেওয়া হয় কেন?
প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কিংবা রেললাইন পেরোতে গিয়ে আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি দুটো লাইনের মধ্যে অসংখ্য পাথর টুকরো ফেলা থাকে।কেবল লাইনের মধ্যেই নয়, রেল লাইনটাই এই পাথর টুকরোর বিছানার ওপর পাতা রয়েছে।খেয়াল করেছি সবাই, কিন্তু ভেবে দেখেছি কি এই পাথর টুকরো কেন ফেলা থাকে রেললাইনে?
কেন ফেলা থাকে সেটাতো জানবই কিন্তু কি ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় রেল ইঞ্জিনিয়ারদের একটা হাই স্পিড ট্রেনকে নিরাপদে লাইনের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আগে সেটা জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমত:ওই মাইলের পর মাইল বিস্তৃত লম্বা ধাতব রেল লাইন যেটা খোলা আকাশের তলায় সারাজীবন পড়ে থাকে ঝড় জল গরম ঠান্ডা সব সামলে তাকে অত্যধিক গরমে আয়তনে বাড়তে এবং অত্যধিক ঠান্ডায় আয়তনে কমতে দিলে চলবে না কোনোমতেই।
দ্বিতীয়ত: বিশাল দানবাকৃতি ট্রেনগুলো লাইনের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মাটিতে এমন কম্পন শুরু হয় যে ওই লাইন তার জায়গা থেকে সরে যেতে পারে এবং এই সরে যাওয়া একচুল হলেও ট্রেনের পক্ষে ভয়ংকর বিপদ।সুতরাং কম্পনেও রেল লাইনকে স্থানচ্যুত করতে দেওয়া যাবে না কোনো মতেই।
তৃতীয়ত: তুষারপাত, কুয়াশা, বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদির ফলে রেল লাইনগুলো যে মাটির ওপর লাগানো সেই মাটিতে জল সেচনের ফলে আগাছা জন্মানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর আমরা জানি একবার আগাছা জন্মাতে দিলে রেল লাইনের অধিকাংশই তাদের দখলে চলে যাবে ফলে রেল চলাচল কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।সুতরাং আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না।
এইসব কারণকে মাথায় রেখে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ট্রেন চালাতে আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে মানুষ যে কারিগরি দক্ষতার সাহায্য নিয়েছিল আজ এতবছর পরেও তার থেকে বেশি কার্যকরী কোনো পদ্ধতি ইঞ্জিনিয়াররা বের করতে পারেননি।
কি সেই কার্যকরী দক্ষতা জানা যাক বরং।
১.মাটির ওপর গ্রানাইট পাথর টুকরো করে রেল লাইন যেখানে পাতা হবে সেইখানকার মাটির ওপর পুরু করে স্তরে স্তরে ছড়িয়ে দিয়ে সেই গ্রানাইটের স্তরের ওপর লাইন পাতা হয়।এত ঝামেলার কারণ? বন্যার সময় লাইন যাতে ডুবে না যায় তাই লাইনকে যতটা সম্ভব মাটি থেকে উঁচুতে বসানো।
দ্বিতীয়:এবার ওই পাথর টুকরোর স্তরের ওপর লম্ব ভাবে কাঠের বিম নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুসারে বসানো হবে যার ওপর রেল লাইন আটকানো থাকবে। রেল লাইন বসানো হয়ে গেলে তার চারপাশে প্রচুর পরিমাণে গ্রানাইটের টুকরো ফেলা হতে থাকে এবার রেল লাইনের মাঝে পাশে চারিদিকে।এগুলোকে ‘ ট্র্যাক ব্যালাস্ট(Track Ballast)’বলে।এখানে একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই পাথরগুলো ভাঙার সময় এমনভাবে ভাঙা হয় যাতে এগুলোর প্রান্তভাগ গোলাকার মসৃণ না হয়ে ধারালো অমসৃণ হয়। এই অমসৃণ ধারালো প্রান্তভাগ রাখার কারণ এগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়ার পর নিজেদের মধ্যে ঘষা খেয়ে পিছলে একে অন্যের ঘাড়ে যাতে উঠে না পারে। গোলাকার প্রান্তভাগে এ সমস্যাটা হয়ে থাকে।অমসৃণ ধারালো প্রান্তভাগের এই পাথরগুলো একে অন্যের সাথে এমন ‘ইন্টারলকিং’ পদ্ধতিতে আটকে থাকে যে কখনোই এরা নিজের জায়গা থেকে সরে যায়না।
এই পাথর টুকরো কতটা ফেলা হবে সেটা নির্ভর করে কাঠের যে বিমগুলো লাগানো থাকে সেগুলোর আকার এবং একে অপরের থেকে কতটা দূরত্বে অবস্থান করছে তার ওপর।এই বিমগুলো কে আবার একএক দেশে একেক নামে ডাকা হয়।যেমন ভারত এবং ব্রিটেনে- স্লিপারস; আমেরিকায় ‘ক্রস টাই বা রেলরোড টাই’;ইউরোপীয় পর্তুগীজে ‘ট্রাভাস’;আবার ব্রাজিলীয় পর্তুগীজে ‘ডরমেন্ট’;রাশিয়ানে ‘শাপলা’, ফরাসিতে ‘ ট্রাভার্স’।এ ছাড়াও ঐ রেল লাইনের ওপর দিয়ে সারাদিনে কতগুলি ট্রেন আসা যাওয়া করে সেটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এই ব্যালাস্ট বা পাথর টুকরো কোনমতেই ৬ ইঞ্চি পুরুর কম হয় না।হাই স্পিড রেল লাইনে এটা ২০ইঞ্চি পর্যন্ত পুরু হয়। এই পুরু করে ফেলা পাথর টুকরোর ওপর প্রথমে কাঠের বিমগুলো বসানো হয়।তার ওপর রেল লাইন।তবে ইদানিং কাঠের স্লিপারের বদলে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার হচ্ছে।
৩. একদম নিচের পাথর টুকরো গুলো বড় হয়। তারপর চাপানো থাকে ছোট পাথর টুকরো। এইভাবে স্তরে চাপানো পাথর টুকরোর মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন বৃষ্টির জল বেরিয়ে যেতে পারে না জমে, তেমনি আবার স্তরে স্তরে সাজানো পাথর টুকরোর ওপর বসানো রেল লাইন মাটি থেকে এতটাই উঁচুতে থাকে যে বন্যার সময় জল সহজে রেল লাইনে পৌঁছতে পারে না।ফলে ট্রেন যাতায়াতের কোন বিঘ্ন হয় না।
source :sobbanglai